গাঁজাগামী নৌবহর সুমুদ ফ্লোটিলার ৪০ নৌযান আটক, বিশ্বজুড়ে নিন্দা আর ক্ষোভ প্রকাশ
নিউজ-ডেস্ক, আজকের বাংলাদেশ;
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার লাইভ ট্র্যাকার অনুযায়ী, মিকেনো নামের একটি নৌযান বর্তমানে গাজার আঞ্চলিক জলসীমায় অবস্থান করছে। তবে ইসরায়েলি বাহিনী সেটি আটক করেছে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। ট্র্যাকারের তথ্যমতে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় মোট ৪৪টি নৌযান ছিল।
Table of Contents
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার অন্তত ৪০টি নৌযান আটক করা হয়েছে। যাত্রীদের সবাইকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে
ফ্লোটিলা ট্র্যাকারের তথ্যমতে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় মোট ৪৪টি নৌযান ছিল।
এদিকে ইউরোপীয় গ্রীন পার্টি ফ্লোটিলা আটকের ঘটনাকে 'আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এক বিবৃতিতে দলের সহসভাপতি ভুলা তসেতসি বলেন, 'মানবিক সহায়তা আটকে দেওয়া এবং স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের কণ্ঠরোধ করা অগ্রহণযোগ্য।'
তিনি আরও বলেন, 'এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠান ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন অবিলম্বে উদ্যোগ নিয়ে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে।'
এর আগে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার একটি নৌযান গাজার জলসীমায় প্রবেশ করে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার লাইভ ট্র্যাকার অনুযায়ী, মিকেনো নামের নৌযানটি বর্তমানে গাজার আঞ্চলিক জলসীমায় অবস্থান করছে। তবে ইসরায়েলি বাহিনী সেটি আটক করেছে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
এর আগে জানানো হয়েছিল, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর বাধার পরও অন্তত ২৬টি নৌযান গাজার উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলি কমান্ডোরা অব্যাহতভাবে নৌযানগুলো আটকের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এর আগে, গাজার উদ্দেশ্যে মানবিক সহায়তা বহনকারী বেশ কয়েকটি নৌযান এবং তাতে থাকা অধিকার কর্মীদের আটক করে ইসরায়েলের নৌবাহিনী। আটক দুই শতাধিক অধিকারকর্মীর মধ্যে সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক জলসীমার আইন কী বলে
এই জলসীমা ১৮৮২ সালের জাতিসংঘের সমুদ্র আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
এ আইন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জলসীমায় যেকোনো দেশ নৌযান চালাতে পারবে। এ জলসীমার ওপর দিয়ে বিমান চলাচলের স্বাধীনতাও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক জলসীমায় সাবমেরিন ক্যাবল ও পাইপলাইন বসানোর পাশাপাশি মাছ শিকার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণের অনুমতিও রয়েছে। তবে এগুলো হতে হবে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনের আলোকে।
এই জলসীমায় চলাচল করা জাহাজে যে রাষ্ট্রের পতাকা থাকবে, সেই জাহাজে ওই রাষ্ট্রেরই কর্তৃত্ব থাকবে। তবে জলদস্যু কিংবা বেআইনি কর্মকাণ্ড হলে এই কর্তৃত্ব থাকবে না। সে ক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
আগেও আন্তর্জাতিক জলসীমায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল
২০১০ সাল থেকে একাধিক ফ্লোটিলা গাজার ব্লকেড ভাঙার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই সেগুলো ইসরায়েলের হামলার মুখে পড়েছে। আর বেশির ভাগ হামলাই হয়েছে আন্তর্জাতিক জলসীমায়, যেখানে তাদের কোনো ধরনের আঞ্চলিক অধিকারই নেই।
সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০১০ সালের ৩১ মে। সেদিন ইসরায়েলের কমান্ডো বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাভি মারমারায় অভিযান চালায়। তারা ১০ মানবাধিকারকর্মীকে হত্যা করে। আহত হয় কয়েক ডজন মানুষ। হতাহতদের অধিকাংশই তুরস্কের। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা যে পথ ধরে যাচ্ছিল, সেটা আন্তর্জাতিক ও ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক জলসীমার মধ্যে পড়েছে। এই পথে নৌযান চলাচল কিংবা ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার আইনি অধিকার রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (আইটিএফ) সাধারণ সম্পাদক স্টিফেন কটন বলেন, “সমুদ্র আইন খুবই স্পষ্ট— আন্তর্জাতিক জলসীমায় অহিংস ও মানবিক কাজে ব্যবহৃত কোনো নৌযানে হামলা কিংবা সেটা জব্দ করাটা বেআইনি; অগ্রহণযোগ্যও।”
![]() |
| ইসরায়েল গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আটকানোর পর আজ বৃহস্পতিবার ইস্তাম্বুল, এথেন্স, বুয়েনস এইরেস, রোম, বার্লিন ও মাদ্রিদের মতো বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেন ফিলিস্তিনপন্থীরা। ছবি: সংগৃহীত |
৫০০ জনের এই নৌবহরে অন্তত ৪৪টি দেশের প্রতিনিধি ছিলেন, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, স্পেন, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও কলম্বিয়া উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের ছিল, কেউ সরাসরি নিন্দা জানিয়েছেন; আবার কেউ আটক নাগরিকদের জন্য কনস্যুলার পরিষেবা নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গাজা অভিমুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকে বাধা ও অধিকারকর্মীদের ইসরায়েলের আটকের ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছে আল-জাজিরা।
ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আক্রমণ ও আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবাধ চলাচলের অধিকার আছে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বীকৃত তাদের এই চলাচলের স্বাধীনতায় ইসরায়েলের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।’
তুরস্ক
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলের এই হস্তক্ষেপকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করেছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে ‘গণহত্যা চালানো নেতানিয়াহু সরকারের ফ্যাসিবাদী ও সামরিকতাবাদী নীতি, যা গাজাকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে, যা শুধু ফিলিস্তিনিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়’।
মালয়েশিয়া
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলকে জবাবদিহি করার জন্য ‘‘সব বৈধ ও আইনানুগ ব্যবস্থা’’ নেওয়া হবে। ইসরায়েল শুধু ‘‘ফিলিস্তিনি জনগণের মৌলিক অধিকারকে অগ্রাহ্য করছে না; বরং বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের বিবেককেও পদদলিত করছে’’।’
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা নৌবহরে অংশগ্রহণকারীদের অবিলম্বে মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন এবং নিশ্চিত করেছেন, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি নকোসি জুয়েলিভেলিলে ম্যান্ডেলাও রয়েছেন।
এক বিবৃতিতে সিরিল রামাফোসা বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন নৌবহরে থাকা জীবনরক্ষাকারী পণ্য গাজার মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। কারণ, এই নৌবহর গাজার প্রতি সংহতির প্রতীক, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের নয়।
কলম্বিয়া
প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো এক্সে ঘোষণা দেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সরকার ইসরায়েলি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করছে এবং কলম্বিয়ার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করছে।
গুস্তাভো পেত্রো বলেন, তাঁদের নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের জন্য কলম্বিয়াকে ‘ইসরায়েলি আদালতের মাধ্যমেও সব ধরনের উপযুক্ত দাবি জানাতে হবে’।
ইতালি
ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইসরায়েল তাঁকে আশ্বস্ত করেছে যে নৌবহরের বিরুদ্ধে ‘কোনো সহিংস কর্মকাণ্ড’ চালানো হবে না।
ইতালীয় ইউনিয়নগুলো আলাদাভাবে আগামীকাল শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, যা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ও গাজার প্রতি তাদের সংহতি প্রদর্শন করবে।
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে, নৌবহরকে ইসরায়েলের বাধা দেওয়া নিয়ে তারা ‘খুবই উদ্বিগ্ন’ এবং এতে ‘অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিকের পরিবারের সঙ্গে’ তারা যোগাযোগ রাখছে।
এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, নৌবহরে থাকা ত্রাণ মানবিক সংস্থাগুলোর কাছে হস্তান্তর করা উচিত, যাতে তারা নিরাপদে গাজায় পৌঁছে দিতে পারে।
গ্রিস
গ্রিস এই সপ্তাহের শুরুতে ইতালির সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে তারা ইসরায়েলের প্রতি ‘গাজামুখী নৌবহরে অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করার আহ্বান জানায়।
আয়ারল্যান্ড
আইরিশ প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি হিগিনস বলেন, ‘ইসরায়েল গাজায় অপরিহার্য ত্রাণ পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে। এই মানবিক কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা আমাদের সবার এবং যেসব দেশ থেকে তাঁরা এসেছেন, সেসব দেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়।’
পাকিস্তান
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নৌবহরের ওপর ইসরায়েলের হামলাকে ‘নৃশংস আক্রমণ’ আখ্যা দিয়ে আটক ব্যক্তিদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এ বর্বরতা বন্ধ করতে হবে, শান্তিকে সুযোগ দিতে হবে এবং সহায়তা অবশ্যই গাজার মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।



কোন মন্তব্য নেই